ভ্রমণের পরিকল্পনা:
অনেকদিন ধরেই মন চাচ্ছিল কোথাও থেকে ঘুরে আসি কাজের ব্যস্ততা আর এই করোনাকালীন সময়ে আসলে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা তাও ভাবছিলাম। তো হঠাৎ করে একদিন যাওয়া-আসার টিকেট এবং হোটেল বুক করে ফেলি। এবার আমাদের সংক্ষিপ্ত ট্যুর এবং রয়েল টিউলিপ থেকে ২ রাত ৩ দিনের প্যাকেজটি বেছে নিলাম। আর ভাবলাম এভাবে হয়তো ঠিক আছে, না হলে হয়তো যাওয়াটা পিছিয়ে যেতে পারে, সবকিছু মিলিয়ে কিছুটা হাঁফিয়ে উঠছিলাম। হ্যাঁ দেখতে দেখতে ২৭ শে নভেম্বর চলে আসলো, যেহেতু আমাদের যাওয়ার দিন ছিল শুক্রবার এবং সপ্তাহের শেষ দিন কাজের ব্যস্ততা থাকবে, তাই সকালের পরিবর্তে রাতে যাওয়ার প্ল্যান করি এবং রাতে বিমানের টিকিট না থাকায়, বাসে যাওয়ার প্ল্যান করি এবং ফিরে আসার সময় বিমানের টিকেটও কেটে রাখি।
আমাদের যাত্রা ও কক্সবাজারে পৌঁছানো:
করোনাকালীন সময় একটু সাবধানে থাকতে হবে, এইভেবে যাবার সময় খাবারও রান্না করে নিয়ে নেয় আমার গিন্নি। যেটা রাতে হোটেলে যাত্রাবিরতি দেওয়ার সময় আমরা খেয়ে নেই। ছোট বাপ্ জানরে সাথে করে এই ট্যুরে নেই নাই, মনটা অনেকটাই তার জন্য খারাপ লাগছিল। দেখতে দেখতে সকাল ৬টা নাগাদ আমরা কক্সবাজারের কলাতলীতে এসে বাস থেকে নামলাম, এবারের বাস ভ্রমণ(শ্যামলী বিজনেস ক্লাস) টা ভালই ছিল। খুব একটা কষ্ট সাধ্য ছিল না, কোথাও তেমন যানজটে ছিলাম না, আরামসে আমরা কক্সবাজারে পৌঁছে গেলাম।
কক্সবাজারের নতুন সৌন্দর্য:
কলাতলীতে রয়েল টিউলিপের অতিথিদের জন্য রয়েছে বিশ্রামাগার, সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কলাতলী থেকে রয়েল টিউলিপের বাস অতিথিদের নিয়ে যায় এবং এর দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার, যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের মত। আমরা যেহেতু সকালের দিকে পৌঁছে গিয়েছিলাম তাই রয়েল টিউলিপের কলাতলীর বিশ্রামাগারে আমাদের সকল তল্পিতল্পা রেখে চলে গেলাম সুগন্ধা বীচে কিছুটা সময় কাটাতে। সুগন্ধা বিচে গিয়ে অনেকটা অবাক কক্সবাজার সমুদ্রে এই প্রথম নীলাভ্র মনে হচ্ছে। এর আগেও কক্সবাজার দুইবার গিয়েছিলাম কিন্তু সমুদ্রের এমন দৃশ্য কখনো চোখে পড়েনি আর এমন চমৎকার সকালে এই দৃশ্য দেখে অবশ্যই নয়ন জুড়িয়ে যাওয়ার মত একটা বিষয় এবং নিজের চোখে উপলব্ধি করলাম, অনেকটা রোমাঞ্চিত ছিলাম। মনটা অনেকটা সতেজ হয়ে গেল এবং মনে হল মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের এই দুই-আড়াই ঘন্টা কেটে গেল।
এক অপরূপ সমুদ্র সৈকত অবলোকন:
সাড়ে নয়টার দিকে রয়েল টিউলিপের বাস এসে আমাদের নিয়ে গেল এবং রয়েল টিউলিপের রিসিপশনে চেকইন করে, সামনের লবিতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই চোখ গেল সামনের দিকে, সামনের দিকে তাকাতেই আমি বিস্ময়ে হতবাক। একি আমি আমার বাংলাদেশে নাকি অন্য কোথাও বসে আছি। মুহূর্তের মধ্যেই মনে পড়ে গেল আমার ইন্দোনেশিয়ার বালি ভ্রমণ এর কথা এবং বারবার মনে হচ্ছে আমি যেন ফিরে এসেছি ইন্দোনেশিয়ার বালির কুটা বীচে। যারা ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়ার বালি ভ্রমণ করেছেন তারা অনেকেই আমার এই কথার সাথে একমত হবেন কারণ রয়েল টিউলিপের সামনে সী পার্ল বিচ-ভিউ অনেকটাই বালির কুটা বিচ এর সাথে সাদৃশ্য। হোটেলে আমাদের চেক-ইন টাইম ছিল দুপুর দুইটা কিন্তু আগেই তাদের রিকোয়েস্ট করেছিলাম যেন একটু তারারাতি চেক-ইন ব্যবস্থা করে দেয় এবং দুপুর ১২ টা নাগাদ হোটেল রুমে চেক-ইন করি। হোটেলের ইন্টেরিয়ার ডিজাইন খুব ভালো এবং হোটেলের বারান্দায় দাঁড়ালে একপাশে পাহাড় আর আরেক পাশ থেকে সমুদ্র দুটোই দেখা যাচ্ছিল যা এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, আসলেই মন জুড়িয়ে যাওয়ার মত এক দৃশ্য। আর কক্সবাজারে সমুদ্রের জলের নীলাভ রূপটা সেই দৃশ্যকে অন্যরকম মাত্রা এনে দিয়েছে।
রয়েল টিউলিপ এবং হোটেলের পরিবেশ ও খাবার দাবার:
রুম থেকে চলে আসলাম হোটেলের সুইমিং পুল এর দিকে। আমার ছেলে তো মহাখুশি, নেমেই দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে, সুইমিং পুলের পরিবেশটা অনেক ভালো। লাঞ্চের সময় হয়ে যাচ্ছিল তারপরও ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে আসলাম দুপুরের খাবার খেতে। হোটেলের খাবারের মানটা বেশ ভালো ছিল, অনেক রকমের আইটেম ছিলো। তবে সব চেয়ে আমার বেশি ভাল লেগেছে ওদের ডেজার্ট আইটেম গুলো। আমার ছেলেরও খুব পছন্দের ছিল। দুপুরের খাবার খেতে খেতেই কিছুটা ক্লান্ত অনুভব হচ্ছিলো কারণ রাতের বাস ভ্রমণ এবং সবকিছু মিলিয়ে ঘুম পাচ্ছিলো, তাই দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে চলে আসলাম সমুদ্রসৈকতে, রাতের সমুদ্র আর সমুদ্রের পানির গর্জন দুটো মিলে আসলে এক অসম্ভব ভালোলাগার অনুভূতি। অনেকক্ষণ সময় কাটালাম সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটলাম, পানিতে পা ভেজানো আর অর্ধাঙ্গিনীর সাথে খোশ গল্পে মেতে ওঠা, হাহাহা 😊।
দেখতে দেখতে প্রায় রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেল, হোটেলে ফিরে ডিনার সেরে নিলাম, রাতের ডিনার টাও বেশ ভালো ছিল খুবই উপভোগ করলাম এবং ডেজার্ট আইটেমসহ। রয়েল টিউলিপে দ্বিতীয় দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, সকালের নাস্তাটা সেরে নিলাম। নাস্তা সেরে আবার চলে গেলাম সমুদ্রসৈকতে, সমুদ্রের পানিতে নামলাম আর আবার বারবার মনের স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল ইন্দোনেশিয়ার বালি ভ্রমণের এর কাহিনী। অনেক সুন্দর সুন্দর ছবিও তুলে নিলাম, যা ইতিমধ্যেই আপনারাও দেখেছেন 😊।
সী-পার্ল ওয়াটার কিংডমে কিছুক্ষণ:
সমুদ্র সৈকতে ঘন্টাদুয়েক সময় কাটিয়ে আবারো চলে আসলাম সী-পার্ল ওয়াটার কিংডমে। আমার ছেলেকে এইবার আর পায় কে। সে যেন ফিরে পেয়েছে অন্য জগত, বাচ্চাদের ছোটাছোটি এবং খেলার বিভিন্ন প্লেগ্রাউন্ড, সেজেছে এক অন্য ভুবন এবং আমার ছেলেও মেতে উঠেছে মনের আনন্দ ভরে। তার সাথে আবার আমি ও আমার অর্ধাঙ্গী, মনে হয় সেই ছোটবেলায় ফিরে গেলাম। এই ওয়াটার কিংডমে ছোট-বড় সবার জন্যই অনেক ধরনের রাইড রয়েছে এবং বড়দের জন্য অনেক এক্সাইটিং কিছু রাইড রয়েছে, অনেক উপভোগ করলাম। সমুদ্রসৈকতে আর ওয়াটার কিংডমে আমরা তিনজন মিলে প্রায় চার ঘণ্টার মতো সময় অতিবাহিত করলাম এবং মনে মনে কিছুটা ভয়ও হচ্ছিল আবার জ্বর-সর্দি চলে আসে কিনা তবে ভগবানের অশেষ কৃপায় কিছুই হয়নি।
সমুদ্রের পাড় থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য:
হোটেল রুমে ফিরে, ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম এবং কিছুটা বিশ্রাম নিলাম। সূর্যাস্তের সময় আবার চলে আসলাম সমুদ্রসৈকতে, সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের দৃশ্য এবং সমুদ্রের চারপাশের রক্তিম আবহ যেন অন্যরকম অনুভূতি, সমুদ্রের বিশালতা আর এই সুন্দর পরিবেশ সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যেন ক্ষণিকের জন্য এক মায়াবী স্থানে ফিরে এলাম।
রয়েল টিউলিপের রাতের পরিবেশ:
সমুদ্রতীরে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে এবার রয়েল টিউলিপের পুরো পরিবেশটা হেঁটে হেঁটে দেখলাম এবং রাতের সৌন্দর্য অবলোকন করলাম। চারপাশ ঘুরে দেখতে দেখতে আমাদের রাতের খাবারেরও সময় হয়ে এসেছে, রাতের খাবার শেষে হোটেল রুমে ফিরে আসলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম আগামীকালই আমাদের রিটার্ন আর ভাবলাম এই ক্ষণিকের জন্য আসলাম আর এত কিছু উপভোগ করলাম, বিশেষ করে কক্সবাজারের এবারের সমুদ্র এবং পুরো সৈকত এরিয়া এবং সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আরো কয়েকটা দিন এখানেই থেকে যায়।
ফিরে আসার অনুভূতি:
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে আবারো সমুদ্রের সেই মায়াবী টানে সমুদ্রের তীরে ফিরে আসলাম, কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে হোটেল রুমে ফিরে চেক-আউট এর জন্য প্রস্তুত হলাম এবং ঢাকায় ফিরে আসার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার এয়ারপোর্ট এর দিকে রওনা হলাম। তবে এবার আমি কক্সবাজারে গিয়ে যে সৌন্দর্য অবলোকন করলাম তা সত্যিই এক মায়াবী অবলোকন, যা আমি আমার ইন্দোনেশিয়ার বালি এবং থাইল্যান্ড ট্যুর এ পেয়েছিলাম, যা এখনও স্মৃতিতে চির অম্লান। হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট ফিরে আসার যে রাস্তা, সে এক অপরূপ সৌন্দর্য একপাশে ছোট ছোট পাহাড়ের দৃশ্য আরেক পাশে আমাদের কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের জলের নীলাভ রূপটা আসলেই অন্য মাত্রা যোগ করেছে। রয়েল টিউলিপের নিজস্ব পরিবহন দিয়ে যাচ্ছিলাম হাতের বা-পাশে পাহাড়ে ঘেরা এক অপরূপ পরিবেশ আর ডান দিকে চোখ পড়লেই নীল সমুদ্রের জাদুকরী দৃশ্য এ যেন স্বর্গের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, আবারো স্মৃতিতে ভেসে উঠলো থাইল্যান্ডের ক্রাবি এয়ারপোর্টে নেমে যখন এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাচ্ছিলাম প্রায় একই রকম দৃশ্য যা আমাদের কক্সবাজার থেকেই অবলোকন করছিলাম, সত্যিই অপূর্ব।
অবশেষে, হোটেলের আতিথিয়তা এবং সবকিছু মিলিয়ে রয়েল টিউলিপকে আমার কাছে অনেক ভালো মনে হয়েছে আর এবার আমাদের ভ্রমণে আদার ব্যাপারীর যে টি-শার্টগুলো প্রদান করেছে, তা সত্যিই আমাদের এই ভ্রমণকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে বিশেষ করে আমাদের ছবিগুলোতে, অসংখ্য ধন্যবাদ আদার ব্যাপারী।
নোট: দয়াকরে সব জায়গায় ভদ্রতা বজায় রাখুন আর প্লাস্টিক, পলিথিন ও অপচনশীল জিনিস এখানে সেখানে ফেলবেন না। প্রকৃতি পরিস্কার রাখার দায়িত্বও আপনার আমার সকলের। মনে রাখবেন ধনী-গরীব যেই হোক না কেন প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই সমান।