সিকিম ভ্রমণের ডায়েরি:
সিকিম যাওয়ার প্ল্যানটা আসলে অনেকদিন থেকেই। সিকিম যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম একসাথে বোনের বাড়িতেও বেড়াতে যাবো আবার সেখান থেকে সিকিমও ঘুরতে যাবো। তো ব্যাপারটা এমন যে রথও দেখতে যাবো, কলাও বেচবো 🙂। ভিসা অনেক আগে থেকেই করে রেখেছিলাম। যাবো যাবো করেও যাওয়া হচ্ছিলো না। আর এদিকে আমার দ্বিতীয় অনাগত সন্তানের পৃথিবীতে আসা উপলক্ষে ট্যুরটা কিছুদিন পেছানো হয়। অবশেষে সুযোগ পাই ডিসেম্বর মাসে, ঐ সময় ক্রিসমাস আর থার্টিফার্স্ট নাইট উপলক্ষে আমার ইউএসএ ক্লায়েন্টের কাছ থেকে ছুটি পাই। ফলে সুযোগটা হয় একদম সোনায় সোহাগা।
আমার বোন জামাই ও তার এক বন্ধু বললেন তারাও যেতে আগ্রহী। ভ্রমণসঙ্গী হলেন তারা দুজন। আমার দুই সঙ্গীর কথা না বললেই নয়। আমার ভগ্নীপতির নাম শেখর সাহা। আর তার বন্ধুর নাম রাজা, রাজা দাদা নামেও রাজা আবার মনের দিক দিয়েও রাজা বলতে পারেন। তারা দুজনেই অনেক অমায়িক মানুষ। অনেক যুক্তি দিয়ে কথা বলেন, কখনো অযথা রাগেন না। তাদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।
শহর কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা:
বাংলাদেশ থেকে আমি কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হই ২৬শে ডিসেম্বর ২০১৯। ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে কলকাতা এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাই ৩৫ মিনিটের মধ্যে। সেখান থেকে আমার বোনের বাসা কলকাতায় চলে যাই। আমার ভগ্নীপতি ও রাজা দাদা আগে থেকেই সব গুছিয়ে রেখেছিলেন সিকিমে যে হোটেলে উঠবো। রাজা দা এর আগেও দুইবার সিকিম ঘুরতে গিয়েছে। তার কাছ থেকে সব বিবরণ পাই যা শুনে খুব ভালো লাগলো। যেহেতু দুইবার ঘুরে এসেছে তাই আবহাওয়া ও অন্যান্য দিক তার খুব ভালো জানা। যে হোটেল ভাড়া করা হয়েছে সেখানকার লোককে ফোন করে জানানো হয় আমরা আসছি। আমি বোনের বাসায় থাকব বলে কলকাতা হয়ে গিয়েছিলাম, বাংলাদেশ থেকে চ্যাংড়াবান্ধা-বুড়িমারি বর্ডার থেকে শিলিগুড়ি খুব সহজেই যাওয়া যায়। শ্যামলী পরিবহনের বাস কল্যাণপুর থেকে ছেড়ে যায়। আর এটাই বাংলাদেশ থেকে সিকিম যাওয়ার কম খরচে সবচেয়ে সহজ রাস্তা। তাছাড়াও সিকিমে ঢোকার অনেকগুলো রাস্তা রয়েছে। আপনার ট্যুর প্ল্যানের উপর ভিত্তি করে আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি কোন দিক দিয়ে সিকিমে ঢুকবেন।
প্রথম দিন: গন্তব্য শিলিগুড়ি এবং সিকিমের পারমিট নেয়া:
২৭ তারিখ রাতে কলকাতা থেকে আমাদের সিকিমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়। কোনো এক নির্দিষ্ট কারণে তখন ট্রেনের টিকিট পাওনা যায়নি, তাই আমরা বাসেই যাত্রা শুরু করি। বাস কলকাতা থেকে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে ছাড়ে রাত দশটা নাগাদ, কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি প্রায় ৫৮০ কিলোমিটার। বাসে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা, ভাগ্য খারাপ হলে ট্রাফিক জ্যামের কারণে ঘণ্টা দুয়েক বেশিও লাগতে পারে। পরদিন দুপুর নাগাদ আমরা শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলাম। আর শিলিগুড়ির রাস্তার দুধারে চা বাগানের সারি, বাস ছুটছে আর মনে হচ্ছে যেন চির সবুজের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছি, চমৎকার ভিউ। শিলিগুড়ি থেকে সিকিম যেতে হলে কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ করতে হয়, সিকিম প্রবেশের পারমিট শিলিগুড়ি থেকেও করা যায় আবার সিকিম বর্ডার রংপো থেকেও করা যায়। তবে বর্ডার থেকে করতে হলে সর্বোচ্চ রাত ৮ টার মধ্যেই করতে হয়। আমরা যেহেতু দুপুর নাগাদ শিলিগুড়ি পৌঁছে যাই তো সেখান থেকেই সিকিমের পারমিটটা করে নিলাম। ওখানে পাসপোর্ট জমা দেয়ার পর একটা ফর্ম দিবে, এক কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি সহ ফর্মটি –যাকে বলা যায় অন অ্যারাইভাল ভিসার মতো, তা পূরণ করে জমা দিলে তারা সিকিম ভ্রমণের পারমিট দিয়ে দেয়। গ্যাংটক যাওয়ার পথে অবশ্যই সিকিম বর্ডার রংপো থেকে এই পারমিটটি দেখিয়ে সিকিম ভ্রমণের অনুমতি পূর্বক পাসপোর্টে এরাইভাল সিল নিতে ভুলবেন না।
শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে যাত্রা:
সিকিমে বুক করে রাখা হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য একটি গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। শিলিগুড়ি থেকে আমরা যাই গ্যাংটক, যার দূরত্ব ১২০ কিলোমিটারের মতো। গ্যাংটক হলো সিকিমের রাজধানী। যেহেতু সংকীর্ণ পাহাড়ি রাস্তা, আর যানবাহনও সংখ্যায় বেশি তাই একটু বেশি সময় লাগে। সিকিম বর্ডার রংপো থেকে পারমিটটি দেখিয়ে সিকিম ভ্রমণের অনুমতি নিলাম এবং মাঝ পথে এক রেস্টুরেন্ট থেকে পেট ভরে মমো খেয়ে নিলাম। আমরা গ্যাংটকে পৌঁছালাম সন্ধ্যায়। কলকাতায় যখন ছিলাম প্রায় ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। গ্যাংটকে নেমে তাপমাত্রা দেখলাম ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। অনেক ঠান্ডা অনুভব হচ্ছিলো। হোটেল রুমে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে নেই। ওখানকার প্রত্যেকটা হোটেলেই গিজারের সুব্যবস্থা আছে। তবুও যেহেতু ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আমরা সাধারণত থেকে অভ্যস্ত না, তাই দুই একদিন মানিয়ে নিতে কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। গরম কাপড়, মোটা মোজা ইত্যাদি ব্যবহার করলে শীত একটু কম লাগবে। প্রথমদিন গ্যাংটক পৌঁছে কাটলো গল্প গুজব করে। আমরা যে হোটেলে উঠেছিলাম সেটি ছিল অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশের, হোটেলের মালিক ছিলেন আমার ভগ্নীপতির বন্ধুর(রাজা দার) পরিচিত। হোটেলের মালিক তিনি অত্যন্ত ভদ্রলোক, আমাদের অনেক আপ্যায়ন করেছিলেন। সকলের নিকট তিনি বাচ্চু দা নামেই বেশি পরিচিত। তাকে আমি হেঁসে একটা কথা বললাম বাংলাদেশ থেকে যত ভাই-ব্রাদার্স যাবে তাদেরকে যে কোন প্রকার হেল্প লাগলে যেন কোন কিছুর কমতি না হয়, সেও হেঁসে বললো কেন নয়, আর ভ্রমণ পিপাসুদের সুবিধার্থে তার ফেইসবুক প্রোফাইল (রামপ্রসাদ দেবনাথ) লিংক অ্যাড করে দিলাম 🙂। ওখানকার একজন বাবুর্চি ছিল যিনি তিন বেলা রান্না করেছিলেন। রাঁধুনি কাকার কথা না বললেই নয়, খুবই মজাদার রান্না করেন। সিকিমে শাকসবজি ছিল সবই অর্গানিক আর খাবার জল ছিল পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে সংগ্রহ করা।
আমাদের প্ল্যান ছিল গ্যাংটকে শেষের দিন ঘুরবো। তার আগে যেসব স্পটে বরফ আছে যেমন- ছাঙ্গু লেক, ইয়ামথাং ভ্যালি, লাচুং এসব জায়গাগুলো আগে ঘুরবো। আমার পারমিটটা আমি যেদিন করিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন দুপুর ১ টার মধ্যে পৌঁছাতে পারিনি। তাই ইনার পারমিটগুলো করা সম্ভব হয়নি। শিলিগুড়ি থেকে পারমিট পেতে প্রায় বিকাল ৩টা বেজে গিয়েছিলো। তাই পরদিন লাচুং, ছাঙ্গু লেক যেতে পারিনি। কারণ বিদেশী নাগরিকদের জন্য লাচুং, ছাঙ্গু লেক যেতে গেলে, যাবার আগের দিন অবশ্যই দুপুর ১ টার মধ্যে গ্যাংটক থেকে পারমিট করাতে হয়। সিকিম রাজ্য সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী দ্বারা শাসিত আর সিকিম ভারতের মধ্যে হলেও তা সম্পূর্ণ আলাদা একটি স্টেট। যেমনটি চীনের মধ্যে হংকং। ইতিহাস থেকে জানা যায় সিকিম একসময় চীনের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পরবর্তীতে তা চলে আসে ভারতের মধ্যে।
দ্বিতীয় দিন গ্যাংটক শহর ঘুরে বেড়ানো:
সকালে হোটেল রুমের জানালা খুলেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে পেললাম, কাঞ্চনজঙ্ঘা আহঃ। সিকিমে অনেক আকর্ষণীয় স্থান আছে যেসব জায়গায় ভ্রমণ পিপাসুরা ভীড় জমায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লাচুং এর ইয়াংথাম ভ্যালি। সেখানে প্রায়ই বরফ পড়তে দেখা যায়। অঞ্চলটির তাপমাত্রা ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে প্রায় মাইনাস ৮-১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, আর ঠান্ডা বেশি পড়লে তাপমাত্রা মাইনাস ১৪-১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এসব স্থানে যেতে না পারায় পরেরদিনই গ্যাংটক শহর ঘুরি। শহরে বিভিন্ন পয়েন্ট আছে। আপনি কয়টা পয়েন্ট ঘুরবেন (৭ পয়েন্ট/ ১০ পয়েন্ট) তার উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে খরচ। পাহাড়ি রাস্তা আর প্রচণ্ড শীত, তাই আপনাকে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে হবে। আমরা ১০ টা পয়েন্ট থেকে গ্যাংটক শহরটাকে দেখার জন্য গাড়ি ঠিক করি ২,০০০ রূপি দিয়ে। দশটা পয়েন্টের মধ্যে একে একে ঘুরলাম রুমটেক, ওয়াটারফল, তাসী ভিউ পয়েন্ট, হনুমান টক। সময় স্বল্পতার জন্য দেখতে পারিনি ফ্লাওয়ার শো আর বোটানিকাল গার্ডেন। আরও আছে রোপওয়ে, গঞ্জন মন্সট্রি, রাংকা মন্সট্রি। প্রত্যেকটি স্থান অনেক দর্শনীয়। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তাসী ভিউ পয়েন্ট। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে অনেক সুন্দর দেখায়। কল্পনা করুন, ঢালু পাহাড়ি রাস্তা ধরে নীচ থেকে উপরে উঠছেন, উপর থেকে নীচে নামছেন, এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড় দেখছেন, সব মিলিয়ে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য যা কল্পনাতীত। আমরা যেদিন এসে অনেক উঁচুতে ছোট ছোট ঘরবাড়ির লাইটের আলো দূর থেকে দেখছিলাম, দেখে মনে হচ্ছিলো যেন রাতের আকাশের মিটিমিটি তাঁরা। গ্যাংটকে আমাদের দ্বিতীয় দিনটা অনেক ভালো কাটলো। অনেক ফটোশ্যুট করলাম। দিনশেষে শীতের টুকটাক কেনাকাটা করলাম গ্যাংটক শহর থেকে, কারণ পরদিন আমরা যাবো লাচুং!
সিকিমে তৃতীয়দিন গন্তব্য ‘লাচুং’
সকালে গরম জল দিয়ে স্নান করে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম সাড়ে সাতটা নাগাদ। আমাদের গন্তব্য লাচুং এর ইয়াংথাম ভ্যালী। আমাদের হোটেল থেকে খানিকটা পায়ে হাঁটা পথ দূরেই একটা পয়েন্ট আছে যেখানে লাচুং এর জিপগুলো ছেড়ে যায়। এখানকার ট্যুর এজেন্সি বা হোটেল কর্তৃপক্ষ- এর মাধ্যমে এই দূরবর্তী স্পটগুলোর পারমিট করিয়ে নিতে হয়। এই জিপ গাড়িগুলোতে নয়জন যাওয়া যায় তবে ৬-৭ জন গেলে আরামে যেতে পারবেন, গাড়ির মডেলগুলো হলো SCORPIO(সাত সিটের), INOVA(সাত সিটের), XYLO(সাত সিটের), BOLERO (দশ সিটের), Artiga (সাত সিটের)। গ্যাংটক থেকে লাচুং এর দূরত্ব প্রায় ১১৯ কিলোমিটার, যা যেতে লাগে প্রায় ৭ ঘন্টা। আমরা তিনজন এবং বাংলাদেশ থেকে আসা আরও ৫ জন পর্যটক উঠে আমাদের সাথে। গল্প করতে করতে আমরা চলে গেলাম। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ আমাদের জিপ ছাড়লো। যাবার পথে কিছু পয়েন্টে যাত্রা বিরতি দেয়া হলো, আমরা পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হলাম, আমরা লাচুং পৌঁছালাম সন্ধ্যা ৭ টায়। আমার হাত পা যেন জমে যাচ্ছিলো। দেখলাম তাপমাত্রা -৪ ডিগ্রী। লাচুং থেকে ইয়াংথাম ভ্যালী যেতে হলে রাতটা লাচুং-এ কাটাতে হয় সেখানকার স্থানীয় মানুষের ছোট ঘরে। তারা আপনাকে থাকতে দিবে, রাতের খাবার দিবে, বিনিময়ে কিছু অর্থ নিবে। এটাই তাদের উপার্জন মাধ্যম তবে এখন লাচুং এ অনেক হোটেলও হয়েছে। শীতের তীব্রতা প্রথম টের পেলাম লাচুং এ, প্রচণ্ড শীত! রাতে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সিকিমে চতুর্থ দিন এবং ইয়াংথাম ভ্যালির বরফের ছোঁয়া:
সকাল সাড়ে ছয়টায় আমরা জিপে উঠে বসলাম। ১-২কিলোমিটার যাবার পরই আমরা দেখলাম রাস্তার পাশে, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বরফ! জীবনে প্রথম কাছ থেকে বরফ দেখলাম। সে এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি। প্রায় তিন ঘন্টা পর আমরা পৌঁছে গেলাম ইয়াংথাম ভ্যালী। ইয়াংথাম ভ্যালী গিয়ে আশেপাশে ঘুরে দেখলাম, বরফ নিয়ে ছোটাছুটি করলাম। অনেক উল্লসিত ছিলাম। ড্রাইভারকে বললাম আমরা আরও একটু সামনে যাবো, যেখানে গেলে আরও বেশি বরফ দেখা যাবে। তিনি বললেন জিরো পয়েন্টের কথা। জিরো পয়েন্ট চীন বর্ডারের কাছাকাছি। সেখানে প্রচন্ড মাত্রায় ঠান্ডা, তাই স্নোফল হলে গাড়ি আটকে যেতে পারে। তাই সেনাবাহিনীর সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যেদিন লাচুং যাই, তার আগের দিনই কিছু গাড়ি আটকে পড়েছিল স্নোফলের কারণে। তারপর আটকে পড়া পর্যটকদের আর্মি ক্যাম্পেই রাত কাটাতে হয়েছে। এজন্যই এসব জায়গায় আসার পারমিটের দরকার হয় যেন যেকোনো বিপদে, সমস্যায় নিজের সব সঠিক তথ্যের লিখিত প্রমাণ থাকে। সেনাবাহিনী সেই অনুযায়ী তখন সহায়তা করে থাকে।
আমরা জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি আসলাম। মনে হলো যেন একদম পাহাড়ের চূড়ায় এসে গেছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২,০০০ ফুট উপরে তখন আমরা। মনে রাখা জরুরি জিরো পয়েন্টে নিঃশাস নিতে কষ্ট হয় (অক্সিজেন কম বলে), তাই পপকর্ন খেলে কষ্ট কিছু কম হয়। যতই উপরে উঠছি এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের রাস্তাগুলোকে উঁচু ফ্লাইওভারের মতো দেখাচ্ছিল। তার ভাঁজে ভাঁজে সাদা বরফের কুঁচি। সে এক অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য। সেখানে কিছু সময় কাটালাম, ছবি তুললাম। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রাস্তার দুই ধারে আরও বেশি বরফ দেখা গেলো। যেখানেই বেশি বরফ দেখলাম গিয়ে দুই হাতের মুঠোয় নিলাম, ছুটাছুটি করলাম, আনন্দ করলাম। স্লো মোশন ভিডিও করলাম। আমরা আবার লাচুং হোটেলে পৌঁছালাম, দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল ৪ টা নাগাদ জিপে উঠে বসলাম। আমাদের জিপ রওনা হলো গ্যাংটক শহরের উদ্দেশ্যে। হোটেলে পৌঁছালাম রাত ১০ টা নাগাদ, অনেক ক্লান্ত ছিলাম ঐদিন।
সিকিমে পঞ্চম দিন এবং ছাঙ্গু লেক ভ্রমণ:
পরের দিন গন্তব্য ছাঙ্গু লেক। লাচুং এর তীব্র শীত থেকে ঘুরে আসার পর আর তেমন শীতই অনুভূত হচ্ছিলো না। আমরা হোটেল কর্তৃপক্ষকে বলে রাখি যেন সকাল ১০ টার দিকে গাড়ি আসে। গ্যাংটক শহর থেকে ছাঙ্গু লেকের দূরত্ব প্রায় ৪২ কিলোমিটার। প্রায় তিন ঘন্টার মতো লাগে। ছাঙ্গু লেক সবসময় বরফে ঢাকা থাকে। চারপাশে সাদা বরফের চাদরে আচ্ছাদিত পাহাড়ি ঢাল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ছাঙ্গু লেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩,০০০ ফুট উঁচুতে। সেখানেও প্রচন্ড ঠান্ডা। হাতের গ্লাভস ১-২ মিনিট খুলে রাখলেই মনে হয় হাত অবশ হয়ে গেছে। সবসময় নাক, কান, হাত ঢেকে রাখবেন।
আমরা ছাঙ্গু লেকে অনেক আনন্দ করলাম। পাহাড়ের বরফ বেয়ে নীচে নামলাম যাকে স্লাইডিং বলে। তারপর ৩৫০ রূপি দিয়ে রোপওয়ে এর ‘ক্যাবল কার’ –এ উঠলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪,৮০০ ফুট উপরে এই রোপওয়ে। দাদা(ভগ্নীপতি) ভয় পেলেন, আমি আর রাজা দাদা দুজনে উঠলাম। সেদিন আবহাওয়া ছিল ভালো। যে ছবিগুলো তুলেছি, ভিডিও করেছি এতো উপর থেকে, সেগুলো অসাধারণ হয়েছে। এতোটা উঁচুতে যে মনে হয় হাত বাড়ালেই মেঘ, বরফ সব ছুঁয়ে দেখতে পারছি। সে এক অকল্পনীয় সৌন্দর্য্য। এই অনুভূতি কখনো ভোলার নয়। ছাঙ্গু লেক থেকে বিকেল ৫ টায় গ্যাংটকে আমরা হোটেলে ফিরে আসি।
গ্যাংটকে কেনাকাটা:
ছাঙ্গু লেক থেকে ফেরার পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে কেনাকাটার জন্য বের হলাম উল্লেখ্য, গ্যাংটকে শীতের পোশাকের মানের সাপেক্ষে দাম খুবই যৌক্তিক ও সাশ্রয়ী। তাই আপনি পরিবারের সদস্যদের জন্য ও সিকিম ভ্রমণের স্মৃতিবাহক হিসেবে শীতের পোশাক কিনে নিয়ে যেতে পারেন। সিকিমের হস্তশিল্প সংগ্রহে রাখার মত। ফারের টুপি, থাঙ্কা, কার্পেট, চা প্রভৃতি কেনার তালিকায় রাখা যায়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
গ্যাংটকের সব সার্বজনীন এলাকায় ধূমপান, আবর্জনা ছড়ানো এবং থুথু ফেলা আইনত অনুমোদিত নয়। সিকিমে বিদেশীদের জন্য অবাধ প্রবেশে বিধিনিষেধ রয়েছে। ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এক স্বর্গ যার দক্ষিণ দিক ঘেরা আছে পশ্চিমবঙ্গ দ্বারা, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভূটান, পশ্চিমদিকে নেপাল আর উত্তর-পূর্ব দিকে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত। বাংলাদেশীসহ বিদেশীদের নাথুলা, কাটাও, গুরুদংমার, জুলুক, জিরো পয়েন্ট এর যাওয়ার পারমিশন দেওয়া হয় না কারণ এই স্থানগুলো বর্ডার এরিয়া আর ছাঙ্গু লেক, বাবা মন্দির, নাথুলা, জুলুক যাওয়ার রাস্তা একই। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, আপনার যে ইনার পারমিটটা, অবশ্যই আপনার সাথে রাখবেন কারণ যাওয়ার সময় সিকিম বর্ডারে তা জমা দিয়ে পাসপোর্টে আবার ডিপার্চার সিল নিয়ে যেতে হবে। এটা প্রমাণ করে যে আপনি সিকিম থেকে বের হয়ে গেছেন। যদি আপনি এটি জমা না দেন বা পাসপোর্টে সিল না নেন তাহলে আর কখনো সিকিমে ঢুকতে পারবেন না, এটি বেআইনী। তবে অনেকে বলে যে সিকিমে অনেক কড়াকড়ি এই সেই, আসলে তেমন কিছু না। আইন, নিয়ম যা আছে মেনে চললে সহজে, স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে আসা যায়।
গ্যাংটকের আবহাওয়া বর্ষা ও শীতের মৌসুমে বেশ প্রকট হতে পারে। শরৎ ও বসন্তকাল হল গ্যাংটক ভ্রমণের সেরা সময়। এই শহরে মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বসন্তকাল বিরাজ করে অন্যদিকে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত শরৎকাল। এর আগে-পরে গেলে বরফে রাস্তা বন্ধ থাকার সম্ভাবনা থাকবে। আর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে সিকিমে সবচেয়ে বেশি বরফ পড়ে।
শেষ দিন ও স্বদেশে ফেরা এবং সিকিম সম্পর্কে সারমর্ম:
জানুয়ারির ২ তারিখ আমি সিকিম থেকে ফিরে আসি। দুপুর সাড়ে তিনটা নাগাদ জলপাইগুড়ি এসে পৌঁছাই। সেখান থেকে কলকাতার ট্রেন ছিল। ভোর ৪ টায় কলকাতা পৌঁছাই। তারপর বোনের বাড়ি একদিন থেকে ফিরে আসি বাংলাদেশে। গ্যাংটক ও এর আশে পাশের অঞ্চল পুরোটাই সুবিশাল ও দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ে ঘেরা। অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য একে প্রায়ই “পূর্বের সুইজারল্যান্ড” বলা হয়। প্রায় ৩৫ হাজার বাসিন্দার এই শহরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কথায় বর্ণনা করে শেষ করা অসম্ভব। হিমালয় পর্বতমালার সুউচ্চ শিখরগুলির মাঝখানে মনোরম ও আরামদায়ক পরিবেশে গ্যাংটকের অবস্থান। সিকিম ঘুরতে আসা পর্যটকরা সাধারণত রাজধানী গ্যাংটকে থেকে সব জায়গায় ঘুরে। সিকিম ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমি নতুন করে যেন অনুধাবন করেছি পৃথিবীটা আসলে কত সুন্দর! এই ছিল আমার সিকিম ভ্রমণের গল্প। যে গল্প আজীবন আমার স্মৃতির খাতায় এক অধ্যায় হয়ে থাকবে।
খরচাপাতি:
এই ৫ দিনে শপিংবাদে আমাদের তিনজনের মোট খরচ হয়েছিল ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪০ হাজার রূপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৮ হাজার টাকার মতো।
নোট:
দয়াকরে সব জায়গায় ভদ্রতা বজায় রাখুন আর প্লাস্টিক, পলিথিন ও অপচনশীল জিনিস এখানে সেখানে ফেলবেন না। প্রকৃতি পরিস্কার রাখার দায়িত্বও আপনার আমার সকলের। মনে রাখবেন ধনী-গরীব যেই হোক না কেন প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই সমান।
Best of luck brother. always valo thakan life k enjoy k
oren.