ভিয়েতনাম ভ্রমণ শেষে শুরু হয় আমার মালয়েশিয়ার ভ্রমণের শুরু, এশিয়া মহাদেশ ঘুরতে চাইলে মালয়েশিয়া অবশ্যই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে প্রথম দিকে থাকবে। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর বিশ্বের অন্যতম আধুনিক ও নান্দনিক শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম, মালয়েশিয়া শহরটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সুন্দর এবং পরিপাটিভাবে সাজিয়েছে। সুন্দর এ শহরটি গড়ে উঠেছে কিছু অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন, জমকালো শপিং মল, দৃষ্টিনন্দন পার্ক-মসজিদ-মন্দির, বিলাসবহুল হোটেল, সমুদ্রসৈকত, আর মুখরোচক খাবার নিয়ে, আমার কাছে মালয়েশিয়ার খাবার খুবই ভালো লেগেছিল।
কুয়ালালামপুর শহরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার এলাকা। বিলাসবহুল এই এলাকাটি জমকালো শপিং মল আর চোখ ধাঁধানো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর দোকান এবং হাই-এন্ড হোটেল ও রেস্টুরেন্ট দিয়ে ভরা। গুচি, রোলেক্স, শ্যানেল থেকে শুরু করে লুই ভিটন, নাইকি, হারমিজ– উন্নত বিশ্বের সবচেয়ে নামীদামী ব্র্যান্ডগুলোর চেইন শপ রয়েছে কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টারের শপিং মলগুলোতে।
এই এলাকাটি সারা বছরই ক্রেতা ও পর্যটকদের কারণে ব্যস্ত ও প্রাণবন্ত থাকে। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে “মালয়েশিয়া ডে” উদযাপন করতে লোকাল মালয়েশিয়ানরা তাদের জাতীয় পোশাক পরে সিটি সেন্টার এলাকায় ভীড় করেন। সেদিন এলাকাটির পথ-ঘাট ভরে যায় নানা রঙের ছড়াছড়িতে।
ভ্রমনের পূর্বে যেসব ব্যাপারে খেয়াল রাখবেনঃ
✔ভিসা হবার পর ৩ মাস সময় পাবেন। এর মধ্যে ভ্রমন করতে হবে।
✔হোটেল বুকিং ভ্রমনের ১-৩ মাস আগেই চেষ্টা করলে খরচ কিছুটা কমবে।
✔এয়ারলাইন্সের অফারগুলো পেতে চোখ কান খোলা রাখবেন।
✔ভ্রমনের সময় ব্যাগে অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে ব্যাগ ভরবেন না।
✔টিকিট, পাসপোর্ট, ডলার, প্রয়োজনীয় কাপড় জিনিসপত্র ১ সপ্তাহ আগে থেকে গুছিয়ে ফেলুন।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ নোটসঃ
✅ এয়ারপোর্ট থেকে ৫৫ কিমি দূরে সিটি সেন্টার অবস্থিত। এখানে আসতে চাইলে ট্যাক্সি/গ্র্যাব, পাবলিক বাস, এল আর টি/এম আর টি/ট্রেনে করে আসতে পারেন। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে খরচ কম লাগে।
✅ সিটি সেন্টার এলাকাটি বেশ এক্সপেনসিভ। এখানে শপিং করতে চাইলে আপনাকে খরচ করার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে।
✅ রিজনেবল প্রাইসে শপিং করতে চাইলে লিটল ইন্ডিয়া বা চায়নাটাউন এলাকায় চলে যান। সিটি সেন্টারের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম খরচে শপিং করতে পারবেন।
✅ সিটি সেন্টারের আশেপাশে অনেকগুলো স্ট্রিট ফুডের দোকান আছে। সেখান থেকে কম খরচে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিতে পারেন।
✅ মালয়েশিয়ার বিখ্যাত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারস চেনেন না এমন মানুষ খুব কমই আছেন। খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, পোস্টকার্ডে, অথবা স্কুলের পাঠ্যবইতে নিয়মিত চোখে পড়ে টুইন টাওয়ার এর ছবি।
এই মুহুর্তে উচ্চতায় বিশ্বের বৃহত্তম টুইন টাওয়ার এটি। কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার এলাকার প্রধান পর্যটক আকর্ষণ এটি। দালানগুলোর ৮৬ তলার অবজারভেশন ডেকে দাঁড়িয়ে আপনি কুয়ালালামপুরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। অবজারভেশন ডেকে যেতে চাইলে আগেভাগে স্লট বুক করে রাখতে হবে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ নোটসঃ
হোটেল বাছাইয়ের সময় অনেকেই রুমের জানালা থেকে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের ভিউ পাওয়া যাবে এমন জায়গায় থাকতে চান। রাতের বেলা টাওয়ারের মাথায় জমকালো আলো জ্বলে। খুব সুন্দর লাগে দেখতে। সোমবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। পর্যটকদের জন্য প্রবেশ ফি ৮০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত।
কুয়ালালামপুর ভ্রমণঃ কিভাবে যাবেন?
কুয়ালালামপুর যেতে হলে আপনাকে মালয়েশিয়ার ভিসা করতে হবে। সুখবর হচ্ছে এই যে বাংলাদেশীরা মালয়েশিয়া ভিসার (ই-ভিসা) জন্য এখন অনলাইনেই এপ্লাই করতে পারবেন। মালয়েশিয়ার ভিসার জন্য এপ্লাই করতে আপনার যা যা লাগবে তা মালয়েশিয়ান হাই কমিশনের ওয়েবসাইটে দেয়া আছে। মালয়েশিয়ায় বেড়াতে যাওয়ার আগে প্রথমেই আপনার প্রয়োজন হবে দেশটির ভিসা। দাপ্তরিক পাসপোর্ট বাদে সব বাংলাদেশি নাগরিকের জন্যই মালয়েশিয়া ভ্রমণের ভিসা বাধ্যতামূলক। তবে সুখবর হচ্ছে, ই-ভিসার ব্যবস্থা আছে মালয়েশিয়া প্রবেশের ক্ষেত্রে। তাই অনলাইনেই ভিসার আবেদন সেরে ফেলা যায়। আবেদনের খরচটাও খুব একটা বেশি নয়। ভিসার পরই আসে ফ্লাইট বাছাইয়ের পালা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্স, এয়ারএশিয়া, বাটিক এয়ার, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এর বেশ কটি ফ্লাইট প্রতিদিন ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ঢাকা টু কুয়ালালামপুর বিমান ভাড়া ও ফ্লাইট শিডিউল সম্পর্কে জানতে ঘুরে আসুন ভিজিট করুন flightexpert.com অথবা skyscanner.net। কমপক্ষে এক মাস আগে টিকেট কাটলে ভাড়া অনেক কমে পাবেন।
সরাসরি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর পৌঁছাতে লাগে প্রায় ৪ ঘন্টা। প্রায় প্রতিটি এয়ারলাইন্স ফ্লাইটের ৪৮ ঘন্টা আগে তাদের ওয়েবসাইটে অনলাইন চেক-ইনের সুবিধা দেয় যা অনেকেই জানে না। আপনি বুকিং স্লিপে দেয়া নাম, পিএনআর এবং ই-মেইল এড্রেস দিয়ে লগইন করে প্লেনে নিজের পছন্দমতো স্থানে সিট সিলেক্ট করে বোর্ডিং পাস ডাউনলোড করে নিতে পারেন। ফ্লাইট মিসের আশঙ্কা এড়াতে ফ্লাইটের দিন, বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের ক্ষেত্রে অবশ্যই ডিপার্চারের মিনিমাম ২ ঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন। উল্লেখ্য যে, ডিপার্চারের ১ ঘন্টা আগেই বোর্ডিং ক্লোজড হয়ে যায়। কমপক্ষে ৭ দিন সময় নিয়ে কুয়ালালামপুর ঘুরে আসুন।
কুয়ালালামপুর হোটেলঃ কুয়ালালামপুর গিয়ে কোথায় থাকবেন?
কুয়ালালামপুর গিয়ে পর্যটকরা বিলাসবহুল হোটেলে থাকতে পছন্দ করেন। কুয়ালালামপুর সফরের একটা বড় অংশ এর লাক্সারিয়াস হোটেলগুলো। বেশিরভাগ মানুষই কুয়ালালামপুর যায় আরাম আয়েশে কয়টা দিন কাটাতে আর এর নামিদামী ব্র্যান্ডে ভরা শপিং মলগুলোতে শপিং করতে। তাই কুয়ালালামপুরের হোটেলগুলোও মোটামুটি চড়া দামে রুম ভাড়া দিয়ে থাকে। কেএল টাওয়ার বা পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারস এর আশেপাশেই সাধারণত ফাইভ স্টার হোটেলগুলো রয়েছে যার জানালা দিয়ে এই সুবিশাল অট্টালিকাগুলোর অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়।
কিন্তু ফাইভ স্টার হোটেল সবার জন্য অ্যাফর্ডেবল নয়। তাই আমরা তুলনামূলক রিজনেবল প্রাইসে কুয়ালালামপুরে যে হোটেলগুলো আছে সেগুলোর একটা লিস্ট বানিয়েছিঃ
✔Regalia Upper View Hotel
✔Sunway Hotel Putra
✔The Kuala Lumpur Journal
✔Capitol Hotel
✔Travelodge City Centre
✔Cititel Mid Valley
এই হোটেলগুলোর ভাড়া প্রতি রাতে ৪,০০০-৬,০০০ টাকার বেশি নয়।
আজ(১৬ ই আগস্ট ২০২৩) সন্ধ্যার ফ্লাইটে মালয়েশিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা। যেতে যেতে ট্যাক্সি ড্রাইভার ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল, ইংলিশে খুবই ভালো মনে হচ্ছিল কিন্তু তার শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাইমারি লেভেল, তা সত্ত্বেও অনর্গল কথা বলতে পারছে। যেতে যেতে আরো অনেক সুখ দুঃখের আলাপচারিতা হয়। মুহূর্তেই আমাদের এক ঘন্টা শেষ হয়ে গেল, শুভ বিদায় মালয়েশিয়া।
কুয়ালালামপুর ভ্রমণ খরচঃ
কুয়ালালামপুর ঘুরতে যাওয়ার আগে সব মিলিয়ে কত টাকা লাগতে পারে সে ব্যপারে ধারণা থাকা জরুরি। কুয়ালালামপুর ভ্রমণ খরচ নিম্নরুপঃ
✔রিটার্ন বিমান ভাড়া – জনপ্রতি ৪৫,০০০- ৬০,০০০ টাকা (যত আগে টিকেট কাটবেন তত কমে পাবেন)
✔হোটেল রুম ভাড়া – প্রতি রাত ৩,৫০০ -৫,০০০ টাকা
✔সিম কার্ড – ৫০০ টাকা (বর্তমানে সিম রোমিং করা থাকলে সিম না কিনলেও চলবে)
✔খাবার – প্রতিদিন জনপ্রতি ৮০০ – ১,০০০ টাকা
সুতরাং, সব মিলিয়ে কুয়ালালামপুর ভ্রমণে আপনার মোট খরচ হতে পারে প্রায় এক লাখ টাকার কম বেশি। ভ্রমণ করার জন্য সবচেয়ে ভালো হয় গ্রুপে টুর দিলে। যদি তা না পারেন তাহলে চেষ্টা করবেন কাপল হিসেবে টুর দিতে তাহলে আপনাদের অনেকাংশে খরচ কমে যাবে।
পরিশেষে:
এই ভ্রমণে আমার সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, এবং www.sumansaha.me-এ আরও ভ্রমণের গল্প এবং টিপসের জন্য আমার ব্লগটি দেখতে ভুলবেন না।
দয়াকরে সব জায়গায় ভদ্রতা বজায় রাখুন আর প্লাস্টিক, পলিথিন ও অপচনশীল জিনিস এখানে সেখানে ফেলবেন না। প্রকৃতি পরিস্কার রাখার দায়িত্বও আপনার আমার সকলের। মনে রাখবেন ধনী-গরীব যেই হোক না কেন প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই সমান।