মালদ্বীপের ফিহালহুহি আইল্যান্ড থেকে সিঙ্গাপুর যাত্রা:
৩ মে ২০২২, সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে চেকআউটের জন্য রেডি হয়ে যায়। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই চেক আউট করে আমরা রেডি এবং সকাল ঠিক নয়টায় মালদ্বীপের ফিহালহুহি আইল্যান্ড থেকে আবারও স্পিডবোট দিয়ে আমরা এয়ারপোর্টে ফিরে আসলাম। সেখান থেকে সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট। সিঙ্গাপুরের ট্রানজিট ছিল ২৩ ঘন্টার। এই সময়েই সিঙ্গাপুর ভ্রমণের প্ল্যান করে এসেছিলাম আমরা।
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ও সেখানে করোনার বিধি-নিষেধ:
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স নিয়ে না বললেই নয়। সেখানে পরিবেশ, খাবার সবকিছু অত্যন্ত ভালো লেগেছে। তাই কেউ যদি সিঙ্গাপুর হয়ে মালদ্বীপ যান তাহলে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সই সেরা বলে আমি মনে করি। সিঙ্গাপুর সময়ে রাত ৮ টা নাগাদ আমাদের প্লেন ল্যান্ড করে। ইমিগ্রেশনে শেষে ঝামেলা কমাতে আমরা কোনো লাগেজ সাথে নেইনি। ল্যাপটপের ব্যাগেই কিছু জামাকাপড় নিয়েছিলাম।
মালদ্বীপে করোনা বিধিনিষেধ না থাকলেও সিঙ্গাপুরে চিত্র ভিন্ন। আমরা যে হোটেল বুক করে রেখেছিলাম তার নাম হোটেল রয়েল যা এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। মজার ব্যাপার হলো মালদ্বীপে আমি ৫ দিন কাটিয়ে দিলাম কোনো সিম কার্ড ছাড়াই। একই প্ল্যান মতো সিঙ্গাপুরেও কোনো সিম কার্ড কিনলাম না। কারণ ইন্টারনেট এখানে বাতাসের মতো সহজলভ্য।
সিঙ্গাপুরে পৌঁছানো এবং ইমিগ্রেশন:
সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশনের পর আমার চেষ্টা ছিল তাদের মেট্রোরেল ব্যবহারের জন্য এমআরটি কার্ড নিতে। পৃথিবীর সেরা সাবওয়ের মধ্যে সিঙ্গাপুরের মেট্রো সিস্টেম অন্যতম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন ছিল সরকারি ছুটির দিন। তাই আমি কার্ড সংগ্রহ করতে পারলাম না। ফলে বাসে করেই এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল রয়েল এর উদ্দেশ্যে যাত্রা।
বাসে করে যেতে যেতে সিঙ্গাপুর শহরের রাতের দৃশ্য এবং চারপাশ দেখতে দেখতে প্রায় ৪৫ মিনিট সময়ের মতো লাগলো হোটেলে পৌঁছাতে। সিঙ্গাপুরের নিউটন রোডে আমাদের হোটেলটি আগে থেকে বুক করা ছিল। হোটেলে চেক ইন করে নিউটন রোড ও তার চারপাশ ঘুরে দেখলাম এবং রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সিঙ্গাপুরে দ্বিতীয় দিন:
সকালে সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে চলে গেলাম এমআরটি স্টেশন, আমরা ৫ বছর মেয়াদী দুটি কার্ড কিনলাম যার মূল্য ১০ সিঙ্গাপুর ডলার করে। এমআরটি স্টেশনে গিয়ে সবচেয়ে অবাক লেগেছে যে তাদের আন্ডারগ্রাউন্ডেও বহুতল ভবন রয়েছে। মনে হয় যেন ভূমির উপরে যেমন এক নগরী, নীচেও তেমনি আরেক নগরী! স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকলাম ট্রেনের জন্য কারণ আমাদের আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল মেরিনা বে এক্সপ্লোর করব।
মেরিনা বে এবং তার চারপাশের সৌন্দর্য:
মেরিনা বে স্টেশনে আসলাম এবং স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাত্রা শুরু করলাম হাঁটতে হাঁটতে। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই মেরিনা বে স্যান্ড দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল। মেরিনা বে চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলাম, খুবি সাজানো-গোছানো পরিষ্কার পরিপাটি। আর মেরিনা বে তেই সিঙ্গাপুরের সেই বিখ্যাত লায়নের মুখ থেকে পানি পড়ার দৃশ্য। সেখান বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম এবং বেশ কিছু ছবি তুলে স্মৃতিময় করে রাখলাম। দুজনেরটিকেটের মূল্য নিয়েছিল সিঙ্গাপুর ডলার হিসাবে ৫২ ডলার।
মেরিনা বে স্যান্ডস এর উপর থেকে সিঙ্গাপুরের সৌন্দর্য:
মারিনা বে যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ আরেকটি শহর। এর প্রাণকেন্দ্র হলো মারিনা বে হোটেল। এটি সিঙ্গাপুরের একটি অত্যাধুনিক রিসোর্ট কমপ্লেক্স। ২০১০ সালে নির্মিত এই মারিনা বে স্যান্ডস বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিল্ডিংগুলোর মধ্যে একটি। মেরিনা বে স্যান্ডস ওপর থেকে চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে এ যেন একই ছাদের নিচে চীন, মালয়েশিয়া, ভারত আর পাশ্চাত্য দেশগুলোর এক অদ্ভুত মিশেল। ছাদের উপর সুইমিং পুল, রেস্টুরেন্টসহ অবজারবেশন ডেক আছে, যেখান থেকে পুরো সিঙ্গাপুরের আকাশকে ৩৬০ ডিগ্রি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। মেরিনা বে স্যান্ডস এর উপর থেকে সিঙ্গাপুরের ‘গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিল, যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
সিঙ্গাপুরের মেট্রো রেল ব্যবস্থা:
প্রথম দেখাতেই সিংগাপুরের মেট্রো রেল ব্যবস্থা দেখে শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। সিঙ্গাপুরে বেশিরভাগ মানুষ পাবলিক ট্রান্সপোর্টে অভ্যস্ত। প্রয়োজনের তুলনায় প্রাপ্যতা এবং সস্তা হওয়ার কারণে এখানে এটাই সবার প্রথম পছন্দ। রেল ষ্টেশনগুলিকে এখানে বলা হয় MRT (Mass Rapid Transit), যেখানে কয়েক মুহুর্ত পরপর একটা করে ট্রেন থামে। মজার ব্যাপার হলো এই ট্রেনগুলো আদৌ কোনো মানুষ দ্বারা চালিত হয় না, সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়! মাটির নীচে সারা শহরে রেল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। রেলষ্টেশন ছাড়াও পুরো শহরে কিছুদূর পর পর রয়েছে বাস ষ্টেশন, যথারীতি সেখানেও বাস থামে কিছুক্ষণের ব্যবধানে। শহরের যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো স্থানে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে চলে যেতে পারে যে কেঊ।আর তাদের ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা এত উন্নত মানের এবং ম্যাপিং এমনভাবে করা আপনার শুধুমাত্র যদি একটু ইংরেজী জানা থাকে তাহলে খুব সহজেই আপনি চলাফেরা করতে পারবেন।
আরেকটি বিষয় খেয়াল করলাম, এখানে পারতপক্ষে প্রাইভেটকার কেউ ব্যবহার করে না, কারণ ছোট দেশ বলে এখানে এটা খুবই ব্যয়বহুল। সম্ভবত একারণেই খুব ব্যস্ত শহর হলেও এখানে ট্রাফিক জ্যাম নেই বললেই চলে। যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো স্থানে যেতে কতক্ষণ লাগবে তা আগে থেকেই বলা যায়। আমার মনে হ্য় সিঙ্গাপুরের এত উন্নতির পেছনে এটা একটা বড় কারণ।
সিঙ্গাপুরে কেনাকাটা:
সিঙ্গাপুর শহরের কয়েকটি শপিংমলে ঘুরে ফিরে দেখলাম এবং আগে থেকেই প্ল্যান করা যে সিঙ্গাপুর থেকে বাচ্চাদের জন্য অনেক আইটেমই চকলেট নিয়ে আসব। তবে এখানে একটি বিষয় খেয়াল করলাম বেশিরভাগ গ্রোসারি স্টোরই সেলফ-সার্ভিস, মানে আপনি যা কেনাকাটা করেন না কেন আপনাকে নিজে থেকেই স্ক্যান করে তারপর প্রডাক্ট লিস্ট অনুসারে পেমেন্ট করতে হয়। বিষয়টি সত্যিই আমার কাছে কিছুটা অভাগ এবং এমন ভালো লেগেছে।কেনাকাটা শেষে একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম। যদিও সিঙ্গাপুর অনেকটা ব্যয়বহুল তারপরও কেনো যেনো গ্রোসারি জিনিসপত্রের দাম আমার কাছে অনেকটা সহনীয় মনে হয়েছে।
এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা:
দেখতে দেখতে প্রায় তিনটা বেজে গেল, সিঙ্গাপুর টাইম সন্ধ্যা সাতটায় আমাদের রিটার্ন ফ্লাইট চাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে। এমআরটি স্টেশন থেকে সোজা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম এবং ম্যাপ অনুসারে ট্রেনটা পেয়েও গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় আমরা নিজেরাই ইমিগ্রেশন পর্ব শেষ করলাম। বোর্ডিং পাস নিয়ে ফিরতি ফ্লাইট এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্ট এর স্মরণীয় মুহূর্ত এবং বাংলাদেশের ক্রিকেট ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্সের সাথে সাক্ষাৎ:
লাউঞ্চে বসে অপেক্ষা করছি হঠাৎ দেখি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ জেমি সিডন্স, কিছুক্ষণ কথা হল আর আমরা যে ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসবো তিনিও সেই একই ফ্লাইটের যাত্রী। বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হল এবং ধন্যবাদ জানালাম বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্যাটিং এর দিকে তাঁর অনেক পরিশ্রমের জন্য। আমার নিজস্ব একটি কলম উপহার দিলাম এবং তিনিও খুশি মনে নিলেন। পরদিন ফেসবুক কমেন্টেও তিনি সেটা রিপ্লাই দিয়েছিলেন।
অবশেষে দেশে ফেরা:
বিশুদ্ধ নির্মল বায়ুতে অনেকদিন থাকার পর যখন আপনি আবার দূষিত বায়ুতে ফিরে আসবেন আসলে তখন পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। আর তাই মালদ্বীপ থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে দেশে ফিরে এসে আমার কিছুদিন অস্বস্তি বোধ হয়েছে।
তবুও স্বদেশ তো আমার শিকড়, আমার নাড়ি। আর এখানে ফিরতে হবেই। এখনও মালদ্বীপ আর সিঙ্গাপুর ভ্রমণের স্মৃতি আমায় শিহরিত করে তোলে। আমি বিশ্বাস করি এই স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আমৃত্যু। সিঙ্গাপুর সম্পর্কে আরো জানতে ক্লিক করুন!
পরিশেষে, দয়াকরে সব জায়গায় ভদ্রতা বজায় রাখুন আর প্লাস্টিক, পলিথিন ও অপচনশীল জিনিস এখানে সেখানে ফেলবেন না। প্রকৃতি পরিস্কার রাখার দায়িত্বও আপনার আমার সকলের। মনে রাখবেন ধনী-গরীব যেই হোক না কেন প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই সমান।
One thought on “ব্যস্তময় সিঙ্গাপুর, মাটির নিচেও যেন আরেক মায়াবী সিঙ্গাপুর!”