থাইল্যান্ডের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অ্যাডভেঞ্চার!

২০১৯ সালে প্রথমবার থাইল্যান্ডে যাওয়ার পর, ২০২৪ সালে আবার সেই দেশে ফিরে গিয়ে বুঝতে পারলাম কতটা পরিবর্তন হয়েছে। এবার ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল চিকিৎসা সেবা গ্রহণের পাশাপাশি কিছুটা থাইল্যান্ডের সৌন্দর্য পুনরায় উপভোগ করা। এবার প্রতিদিন ছিল একেকটি নতুন অভিজ্ঞতা। চলুন দেখি ধাপে ধাপে সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল।

ভিসা প্রসেসিং:
আমার থাইল্যান্ড ভিসা প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে এবারকার অভিজ্ঞতা ছিল তুলনামূলকভাবে দ্রুত এবং সহজ। যেহেতু আমার আগে থাইল্যান্ডে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল এবং বর্তমানে আমার কাছে স্পেনের রেসিডেন্সি রয়েছে, তাই ভিসা প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত হয়েছে বলে মনে করি। বর্তমান সময়ে থাইল্যান্ডের ভিসা পেতে বেশ কিছু সময় লাগতে পারে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে মাত্র চার কর্ম দিবসের মধ্যেই ভিসা পেয়ে যাই। ভিসা পেতে দেরি হতে পারে সেই জন্য আমাদের ট্যুর-প্ল্যান কিছুটা দেরিতে ছিল কিন্তু অতি দ্রুত ভিসা হয়ে যাওয়ায় আমরাও ট্যুর-প্ল্যান এগিয়ে আনি প্রায় ১৫ দিন আগে।

প্রথম দিন: ব্যাংককে পৌঁছানো:
থাইল্যান্ড যাত্রার প্রথম দিন ছিল ব্যাংককে পৌঁছানোর দিন। বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর আমরা সরাসরি হোটেলে চেক-ইন করি এবং দিনের বাকিটা সময় বিশ্রাম নিই। এই দিনটা মূলত আরামের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছিলাম, বিশেষ করে যাত্রার ক্লান্তি মেটানোর জন্য।

দ্বিতীয় দিন এবং চিকিৎসা পরামর্শ: আমার স্ত্রীর জন্য চিকিৎসা পরামর্শের জন্য বরাদ্দ। সামিটিভেজ হসপিটালে ডাক্তারের সাথে কনসালটেশন করি(গ্যাসটোলজিস্ট ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট আগেই নেয়া ছিল)।সামিটিভেজের সেবা এবং দক্ষতা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। হাসপাতালের অবকাঠামো, চিকিৎসকদের পেশাদারিত্ব, এবং ব্যবস্থাপনা সবই খুবই উন্নতমানের। থাইল্যান্ড স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যে অনেক এগিয়ে গেছে, তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। তাদের ব্যবস্থাপনার গতি এবং রোগী সেবার মনোভাব সত্যিই চমৎকার। সবকিছু খুবই সুসংগঠিত এবং সময়ানুযায়ী ছিল।

তৃতীয় দিন: এই দিনটা মূলত আরামের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছিলাম, বিশেষ করে আগের দিনের ক্লান্তি মেটানোর জন্য। ফুল বডি চেকআপ এবং পরে ব্যাংককের শহুরের সৌন্দর্য উপভোগ, আমার নিজের ফুল বডি চেকআপ ছিল সামিটিভেজ হসপিটালে। চেকআপ প্রক্রিয়া অত্যন্ত পেশাদারভাবে সম্পন্ন হয়েছিল এবং সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। ডাক্তার ফাইনাল রিপোর্ট দেখে বলেছিল, আপনি যেভাবে আপনার ডেইলি রুটিন মেনটেন করছেন এভাবেই চালিয়ে যান এবং এটা ধরে রাখুন।

চিকিৎসার পরের অংশটা ছিল ব্যাংককের কিছু বিখ্যাত স্থান ঘোরার। বিশেষ করে তাদের বড় বড় শপিং মল যেমন সিয়াম প্যারাগন, সেন্ট্রাল ওয়ার্ল্ড, এবং এমবি কে সেন্টার ঘুরে দেখি। প্রতিটি মলই থাইল্যান্ডের আধুনিক স্থাপত্য এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রতিফলন। এরপর বিকেলের দিকে আমরা লোকাল মার্কেট এবং নাইট মার্কেট ঘুরতে যাই, যেখানে স্থানীয় খাবার, হস্তশিল্প তার মধ্যে অন্যতম। রাতের ব্যাংককের আলো ঝলমলে পরিবেশ সত্যিই মনোমুগ্ধকর ছিল। এবং ব্যাংককের মেট্রো সার্ভিসও আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।

এই দিন আমাদের সাথে যোগ দেয় আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই নিতাই এবং তার সাথে ঘুরে ঘুরে শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের(মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাইটি ব্যাংককে ২ বছর যাবৎ আছে এবং এখানকার স্থানীয় একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে (RideBeam) ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার(লেভেল ২)হিসাবে কাজ করছে। আমাদের সাথে আরেকজন ছিল যিনি বাংলাদেশেরই এবং আগোডাতে কাজ করছে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। সবমিলিয়ে পুরো বিকেল, সন্ধ্যা এবং রাতের ডিনার একসাথে করা সময়গুলো ছিল খুবই উপভোগ্য।

This slideshow requires JavaScript.

চতুর্থ দিন: ফুকেট যাত্রা এবং প্রথম দিনের বিশ্রাম
চতুর্থ দিনে আমরা যাত্রা শুরু করি ফুকেট এর উদ্দেশ্যে। ফুকেট একটি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র, যা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমুদ্র সৈকত, এবং অ্যাডভেঞ্চার কার্যকলাপের জন্য পরিচিত। ফুকেটে পৌঁছানোর পর আমরা প্রথম দিনটা বেশিরভাগই বিশ্রামে কাটাই। হোটেল থেকে ফুকেটের আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করি এবং কিছুটা সময় লোকাল রাস্তায় হেঁটে বেড়াই। দিনশেষে আমরা রাতের ডিনার উপভোগ করি, যেখানে থাইল্যান্ডের স্থানীয় খাবারের বিশেষ স্বাদ উপভোগ করার সুযোগ পাই।

থাইল্যান্ডে পঞ্চম দিন: রাফটিং, এটিভি এবং হাতির পিঠে চড়া
ফুকেটের চতুর্থ দিনটি ছিল উত্তেজনা এবং অ্যাডভেঞ্চারের দিন। আমরা পুরোদিনের ট্যুরে অংশ নিই, যেখানে রাফটিং, এটিভি রাইড এবং হাতির পিঠে চড়া অন্যতম আকর্ষণ ছিল।রাফটিংয়ের সময় নদীর স্রোত এবং চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোমুগ্ধকর ছিল। এটিভি রাইডে পাহাড়ি এবং কাঁচা রাস্তায় চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল চ্যালেঞ্জিং, তবে একইসাথে রোমাঞ্চকর। হাতির পিঠে চড়ে প্রকৃতির কাছাকাছি আসার সেই মুহূর্তটি সত্যিই অসাধারণ ছিল।

This slideshow requires JavaScript.

ষষ্ঠ দিন: সিমন ক্যাবারে শো
ফুকেট ভ্রমণের এই দিনে আমরা সন্ধ্যায় বিখ্যাত সিমন ক্যাবারে শো দেখতে যাই। শো-এর অভিনয়, পোশাক, এবং সেট ডিজাইন চমৎকার ছিল। শোটি দেখার মাধ্যমে থাইল্যান্ডের সাংস্কৃতিক দিকের সঙ্গে আরো গভীরভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

থাইল্যান্ডে সপ্তম দিন: বৃষ্টি এবং ট্যাটু করানোর ইচ্ছা পূরণ
ষষ্ঠ দিনে আমরা কিছুটা বৃষ্টির কবলে পড়ি, যার ফলে কিছু কার্যকলাপ যেমন আইল্যান্ড ট্যুর বাতিল করতে হয়। কিন্তু সেই সময়টা আমরা কাজে লাগাই আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ট্যাটু করানোর মাধ্যমে। ফুকেটে থাকাকালীন সময়ে এটি আমার জন্য ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।বিস্তারিত স্বপ্ন যখন শরীরে শিল্প হয়ে ওঠে: আমার ট্যাটুর গল্প!

থাইল্যান্ড অষ্টম এবং শেষ দিন: সমুদ্র সৈকত এবং সিয়াম নিরামিড ভ্রমণ
এই দিনে আমরা যাই ফুকেটের কিছু বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত যেমন পাতং, কারন এবং ক্যাটা বিচে। সেখানে নীল সমুদ্রের ঢেউ, সাদা বালির সৈকত, এবং শান্ত পরিবেশ আমাদের মন জয় করে নিয়েছিল।এরপর আমরা দুপুরের খাবার শেষে ফুকেটের বিখ্যাত সিয়াম নিরামিড ভ্রমণে যাই। এখানে থাইল্যান্ডের প্রাচীন ইতিহাস, স্থাপত্য এবং সংস্কৃতির নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। থাইল্যান্ডের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার জন্য এটি একটি চমৎকার স্থান ছিল।

ভ্রমণের অংশ হিসেবে আমাদের জন্য নৈশ ভোজের ব্যবস্থা ছিল, যা একটি সবুজাভ পরিবেশের মনোরম হলরুমে অনুষ্ঠিত হয়। এই হলরুমটি শুধু আভিজাত্যপূর্ণ নয়, এর প্রতিটি কোণ ছিল নান্দনিকভাবে সাজানো, যা থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির ছোঁয়া এনে দেয়। খাবারের পরিবেশও ছিল অত্যন্ত চমৎকার।

থাইল্যান্ডের উন্নয়ন এবং পর্যটন
২০১৯ এর পর থেকে ২০২৪ সালে থাইল্যান্ডের অবকাঠামোগত পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। বিশেষ করে ব্যাংকক এবং ফুকেটের মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, নতুন নতুন পর্যটন আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। পরিবেশগত দিক থেকেও তারা উন্নয়ন করেছে, যেমন পরিচ্ছন্নতা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে। পর্যটনশিল্পেও অনেক পরিবর্তন এসেছে, নতুন নতুন কার্যকলাপ, এবং পর্যটকদের জন্য উন্নত সেবা দেওয়া হচ্ছে।

পাঁচ বছর আগে ২০১৯ এর আমার থাইল্যান্ড ভ্রমনের ডায়েরি পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন

পরিশেষে দয়াকরে ভ্রমণের সময় সব জায়গায় ভদ্রতা বজায় রাখুন আর প্লাস্টিক, পলিথিন ও অপচনশীল জিনিস এখানে সেখানে ফেলবেন না। প্রকৃতি পরিস্কার রাখার দায়িত্বও আপনার আমার সকলের। মনে রাখবেন ধনী-গরীব যেই হোক না কেন প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই সমান।

থাইল্যান্ডের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অ্যাডভেঞ্চার!

Write a comment....

Scroll to top
error: Content is protected !!