১৫ জুলাই ২০২০ বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস (ডব্লিউওয়াইএসডি)। জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বের তরুণদের বিভিন্ন দক্ষতায় দক্ষ হয়ে ওঠার আহ্বান জানানো এবং ভবিষ্যতের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ যুবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা। এমনি একজন দক্ষ যুবক সুমন সাহার সঙ্গে কথা বলেছে যুগান্তর। সেদিন যুগান্তরের সাথে একান্ত কিছু সময় কাটে আমার সাক্ষাৎকার পর্বে।
যুগান্তর: আপনার গ্রাম, পরিবার ও লেখাপড়ার বিষয়টি নিয়ে কিছু বলুন।
সুমন সাহা: নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার আলীনগর গ্রামে। স্নেহময় পিতা হরিপদ চন্দ্র সাহা ও মাতা পুষ্প রানী সাহার ছায়ায় বেড়ে ওঠা। শিক্ষা- চরসিন্দুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, তারপর নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজ হতে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিভাগ থেকে বিএসসি ডিগ্রী অর্জন।
যুগান্তর: প্রথমেই জানতে চাই, এই করোনার সময়ে আপনার কাজের অবস্থা কী?
সুমন সাহা: আইটি ফ্রিল্যান্সিং করার সুবিধার্থে বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশেরও বেশি মানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমার কথা হয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই তাদের সঙ্গে করোনার ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলি। সকলেই অনেক উদ্বিগ্ন। কিন্তু তাই বলে সব কাজ তো আর থেমে থাকবে না। করোনায় প্রাদুর্ভাব আমাদের ফ্রিল্যান্সিংয়ে পড়েছে, তবে সবক্ষেত্রে নয়। যেমন সোশ্যাল মিডিয়া রিলেটেড কাজ, ই-কমার্স, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি কাজের চাহিদা বেড়েছে অনেক। অর্থাৎ এই বন্দীদশায় থেকেও যে কাজগুলো চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে সেইসব ক্যাটাগরি কাজের চাহিদা অনেক।
যুগান্তর: এই কাজ করার অনুপ্রেরণা পেলেন কীভাবে?
সুমন সাহা: পড়াশুনা শেষ করে আমাকে কিছু একটা করতে হবে এবং আমাকে নিজে নিজে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। মূলত এই চিন্তা থেকে আউটসোর্সিংয়ে আসা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছে আমার স্ত্রী সন্ধ্যা রায়। ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষের দিকে একটি জাতীয় দৈনিকে পড়ে জানতে পারি, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি চাকরি মেলা হবে। সেখানে একটা সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশি হিসাবে কাজ করার জন্য সুযোগ পেলাম। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আউটসোর্সিং সম্পর্কে আরও জানতে পারি। ‘নিজে নিজেই ওডেস্কে (বর্তমানে আপওয়ার্ক) অ্যাকাউন্ট খুলি। কিছু বুঝি না, ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে শিখতে লাগলাম। এবার বিড করা শুরু করলাম। কিন্তু কোনো কাজ পাইনি। একটু হতাশ হয়ে গেলাম। ভাবলাম এভাবে হবে না। আগে স্থানীয় বাজারে কাজ করতে হবে। পরে বাইরে। যেখানে শিক্ষানবিশ করতাম, সেখানে চাকরিও হয়ে গেল। ২০১২ সালে আবার মার্কেটপ্লেসে কাজ শুরু করি। ৫ ডলারের একটি সফটওয়্যার টেস্টিংয়ের কাজও পেলাম। কাজটি ভালোভাবে করে দেওয়ায় বাইরে খুশি হয়ে আরও কয়েকটি কাজ দেয় একটু বেশি মূল্যে। এভাবেই চলতে থাকে। ২০১৩ সালের শুরুতে আইপ্যাড অ্যাপ্লিকেশন টেস্টিং কাজের জন্য সারা বিশ্ব থেকে ৫২ জনের মধ্যে ২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ থেকে সুযোগ পাই আমি। এরপর আর আমার পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
যুগান্তর: আপনি মূলত কোন ধরণের কাজ করে থাকেন?
সুমন সাহা: আমি মূলত এখন দুই ধরনের কাজ করি। ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট এবং এর কারিগরি সেবা নিয়ে কাজ করছি। আউটসোর্সিং (মার্কেটপ্লেস) আপওয়ার্কে কাজ করি সফটওয়্যারের মান নিয়ন্ত্রণ, কারিগরি সেবা এবং মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট নিয়ে।
যুগান্তর: বর্তমানে আপনি এখন কী করছেন?
সুমন সাহা: এখন আমি একটি কোম্পানির সফটওয়্যার রিলিজ ম্যানেজার হিসাবে স্থায়ীভাবে কর্মরত আছি। অ্যান্ড্রয়েড ও আইফোনের বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন আছে এবং সেখান প্রতিটি ভার্সনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সেটা আমাকে ক্লায়েন্টের কাছে পাঠাতে হয়। তাছাড়াও আমার আরও কয়েকটি খণ্ডকালীন ক্লায়েন্ট রয়েছে এবং নানোসফটবিডি একটি স্টার্ট আপ রয়েছে।
যুগান্তর: এই কাজ করতে গিয়ে জীবনের কোন মজার বা স্মরণীয় ঘটনা যদি থাকে?
সুমন সাহা: একবার একটি কাজের ইন্টারভিউয়ের সময় ক্লায়েন্ট কিছুই জানে না এমন ভাব ধরে এবং আমাকে প্রশ্ন করতে থাকে। সে আসলে একজন সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট, যেটা পরে আমি তার সঙ্গে কাজ করার সময় জানি। দলগতভাবে কাজ করতে গিয়েও অনেকে মজার ঘটনা ঘটে থাকে।
যুগান্তর: আপনার এ সাফল্যের রহস্য কী?
সুমন সাহা: যদি বলতে হয় তাহলে এর উত্তর আমার কাছে ধৈর্য এবং ধৈর্য। ফ্রিল্যান্সিং এমন একটা ক্ষেত্র, এখানে আপনাকে ধৈর্য নিয়ে লেগে থাকতে হবে এবং আপনার শিখার ও জানার আগ্রহ থাকতে হবে। আমাদের দেশে যারা একবারে নতুন ফ্রিল্যান্সার, আমি মনে করি তাদের ধৈর্য অনেক কম। এই আউটসোর্সিং ক্ষেত্রে আপনাকে ক্লায়েন্টের কাজ সময়ানুযায়ী শেষ করতে হবে। তবেই সাফল্য ধরা দেবে।
যুগান্তর: ফ্রিল্যান্সিং লাইফে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কোনটি?
সুমন সাহা: একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিক রাহিতুল ইসলাম প্রথম ইন্টারভিউয়ে আমাকে যখন বললেন, আপনার উঠে আসার গল্পটি এবং হৃদয়ছোঁয়া কষ্টের ইতিহাস একটি বইয়ে বাঁধানো যায়। তখন আমি খুব অবাক হয়েছি। ভেবেছি আমাকে নিয়ে লিখতে লিখতেই হয়তো একটা মজা করেছে। আমাকে নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নাম ‘ফ্রিল্যান্সার সুমনের দিনরাত’। সত্যিই এটি আমার জীবনের এক চমকপ্রদ এবং অনেক বড় পাওয়া। আমি আরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আপওয়ার্কের প্রতি। এক আপওয়ার্ক আমাকে যা দিয়েছে বা আপওয়ার্ক থেকে যা যা অর্জন করেছি তা আমার জীবনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
যুগান্তর: আপনার সাফল্যের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন?
সুমন সাহা: জীবনে যতটুকু অর্জন করেছি তার সব মহান ঈশ্বরের কৃপায়, মা-বাবার ও শিক্ষকদের ভালোবাসায়, বন্ধুদের সহযোগিতা, দাদা অনন্ত কুমার সাহার ছায়াতলে আর স্ত্রীর অনুপ্রেরণায়। আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ আর এভাবেই থাকতে ভালবাসি।
যুগান্তর: ফ্রিল্যান্সিং কাজ করতে গিয়ে আপনি কী ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
সুমন সাহা: প্রথমত নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। আসলে আমাদের দেশে সবকিছু নিয়েই ভয় এবং ইন্টারনেট নিয়েও এক ধরণের ভয় ছিল। এক সময় জানতাম, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের সব তথ্য পাচার হয়ে যাবে। ঢাকায় ইন্টারনেটের গতি ভালো হলেও ঢাকার বাইরে গেলেই তেমন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। আপলোডের ক্ষেত্রে এই গতি আরও কমে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের গতি কম হলে আমরা বেশ অসুবিধায় পরি। পেপ্যাল হলে খুব সহজেই দেশে টাকা আনা যেত। সেটা এখনও অধরাই রয়ে গেল।
যুগান্তর: দেশের ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সুমন সাহা: আমি নতুনদের ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে যথাযথ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কারণ নতুনদের অনেকেই শুরুতে অনেক ভুল-ত্রুটি করে থাকে। ক্লায়েন্টের মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বাজে ধারণাও তৈরি হয় যা আমাদের ফ্রিল্যান্সিং জগতে কিছুটা হলেও এর প্রভাব পরে। আর এজন্য আমি নামে একটি ব্লগও তৈরি করেছি। ভবিষ্যতে আমার ইচ্ছা তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের। আমি স্বপ্ন দেখি আগামীতে আমাদের দেশ থেকে খুব ভালো প্রযুক্তিবিশ্লেষক তৈরি হবে এবং আমাদের এই দেশকে প্রযুক্তিখাতে উন্নতির শিখরে তুলে ধরবে।
তথ্যসূত্র: দৈনিক যুগান্তর।