ডেঙ্গু জ্বর কি?
এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু ভাইরাসের কারনে সৃষ্ট জ্বর। মশা বাহিত ডেঙ্গু জ্বর একটি ভয়াবহ আকার নিয়েছে আমাদের দেশে। এই জ্বরের লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের তিন থেকে ১৪ দিন পরে শুরু হয়। এরমধ্যে থাকে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, পেশিতে ব্যথা এবং ত্বকে র্যাশ ওঠা। আবার, আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণু বিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবেই এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস, বিশেষ করে গরম ও বর্ষার (বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী) সময় ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ অনেক বেশি থাকে। অপরদিকে শীতকালে সাধারণত এই জ্বর হয় না বললেই চলে।
ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো কী?
সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। শরীরের তাপমাত্রা ১০১ থেকে ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারো জ্বর আসতে পারে। এর সাথে শরীরে ব্যথা মাথাব্যথা, চেখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ) হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে।
এডিস মশা সম্পর্কে কিছু কথা
এক ধরনের মশা যার শরীরে সাদাকালো দাগ ও কোন কোন ক্ষেত্রে পায়ের দিকে হলুদাভাব রং থাকে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এডিস মশার বিস্তার। পরিস্কার পানিতে এরা বংশ বৃদ্ধি করে। বৃষ্টির পর জমে থাকা পানিতে, ফুলের টবে, ইত্যাদিতে এরা রাতের বেলা ডিম পারে। সকাল বেলা ও বিকেল বেলা এরা খাবারের জন্য মানুষের রক্ত পান করে। এডিস মশা আরো বেশ কিছু মারনঘাতি ভাইরান বহন করে- চিকুনগুনিয়া, জিকা, হলুদ জ্বর অন্যতম।
জ্বর হলে কি করতে হবে?
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা সাধারণ জ্বরের মতোই। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। এমনকি কোনো চিকিৎসা না করালেও। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে যাতে ডেঙ্গুজনিত কোনো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি না হয়। নিম্নে ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসায় করনীয় কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলঃ
- জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল সেবন করতে হবে, দিনে সর্বোচ্চ ৪বার।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
- জ্বর কমানোর জন্য বারবার শরীর মুছে দিতে হবে।
- জ্বরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার, যেমন— ওরাল স্যালাইন, ফলের জুস, শরবত ইত্যাদি পান করতে হবে।
- বমির কারণে যদি কোন রোগী পানি পান করতে না পারেন সেক্ষেত্রে, শিরাপথে স্যালাইন দিতে হবে।
- অ্যান্টিবায়োটিক,অ্যাসপিরিন বা অন্য কোন ব্যথানাশক ওষুধ একেবারেই সেবন করা যাবে না। ডেঙ্গু অথবা ভাইরাল জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার নেই।
- ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে আক্রান্ত হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের রোগীকে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করাতে হবে।
- সাধারণত ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ ১০ হাজারের কম হলে অথবা শরীরে রক্তক্ষরণ হলে প্লাটিলেট কনসেন্ট্রেশন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সিরাম অ্যালবুমিন ২ গ্রাম/ডেসিলিটারের কম হলে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তি শকে গেলে প্লাজমা বা প্লাজমা সাবস্টিটিউ দিতে হয়। যদি রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট ৫০ হাজারের নিচে নেমে যায় তবে জরুরি ভিত্তিতে রক্ত সংগ্রহ করে রাখতে হবে।
ডেঙ্গু হলেই কি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়?
ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ভাগ রয়েছে। এ ভাগগুলো হচ্ছে – ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’। প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা নরমাল থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির।
তাদের হাসপাতালে ভর্তি হবার কোন প্রয়োজন নেই। ‘বি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের সবই স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন তার পেটে ব্যথা হতে পারে, বমি হতে পারে প্রচুর কিংবা সে কিছুই খেতে পারছে না।
অনেক সময় দেখা যায়, দুইদিন জ্বরের পরে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাসপাতাল ভর্তি হওয়াই ভালো। ‘সি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে খারাপ। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ’র প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে যেসব খাবার খেতে হবে:
পেঁপে পাতা
পেঁপে পাতার নির্যাস পেঁপেইন এবং কিমোপেইন সমৃদ্ধ, যা হজমে সহায়তা করে। প্রতিদিন আধা কাপ তাজা পেঁপে পাতার রস রক্তের প্লেটলেট সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু আসলেই কি পেঁপে পাতার রস ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে? ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলেন, পেঁপে পাতার রস যে ডেঙ্গু নিরসনে ভূমিকা রাখে, এই দাবির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
- বেদানা
প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং খনিজ সমৃদ্ধ বেদানা শরীরকে শক্তি সরবরাহ করে। বেদানা খেলে ক্লান্তি দূর হয়। আয়রনের সমৃদ্ধ হওয়ায় বেদানা প্লেটলেট বাড়াতে সহায়তা করে। - ডাবের পানি
ডেঙ্গু সাধারণত ডিহাইড্রেশনের ফলে ঘটে। সুতরাং, শরীরকে আদ্র রাখতেডাবের পানি যা করা অত্যন্ত উপকারী। - হলুদ
একটি অ্যান্টিসেপটিকের কাজ করে। ফলে দুধের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে পান করলে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়। - মেথি
মেথি খেলে ঘুম ভালো হয়, এটি ব্যথা কমাতেও কার্যকর। - কমলা
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ কমলা ডেঙ্গু ভাইরাসের চিকিৎসা এবং নির্মূল করতে সহায়তা করে। - পালং শাক
পালং শাক আয়রন ও ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে। প্লেটলেট স্তর বাড়ানোর একটি কার্যকর উপায় নিয়মিত পালং শাক খাওয়া।
সবশেষে
ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি শরীরে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সাধারনভাবে এই জ্বরে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে সঠিকভাবে চললে কয়েক দিনেই ডেঙ্গুরোগী সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে যায়। যেহেতু এ রোগের কোন ভ্যাকসিন নেই, তাই মশার সংখ্যা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ নষ্ট করা, মশার সংখ্যাবৃদ্ধি হ্রাস এবং মশার কামড় থেকে বেচে থাকার মাধ্যমে ডেঙ্গুজ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
সচেতনতা সবার জরুরী। সিটি কর্পোরেশনরে গালি দিয়া উদ্ধার করতে পারবেন, তাতে কোন লাভ হবে না। সিটি কর্পোরেশন মশার ঔষধ (কাজ করুক আর না করুক) ছিটাবে নালা নর্দমায়, আপনার বাসার ফুলের টবে না, বাড়ির ছাদে না। এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়ায় ও সর্বোচ্চ ৪০০ মিটার যেতে পারে ও বাসার ভিতর থাকে। মাঝে মধ্য বাইরে যায়, তবে রাতের বেলা বাইরে থাকেনা। আপনি সচেতন হলেন কিন্তু আপনার বন্ধু সচেতন না। তার বাসায় গেলে আপনিও আক্রান্ত হতে পারেন। ২৪ থেকে ৩৬ ঘন্টার ব্যবধানে পুরো পরিবার আক্রান্ত হতে পারে। যাহোক, আতংকিত হোন আর না হোন। সচেতন হোন।
সূত্র: ইন্টারনেট এবং সাম্প্রতিক গবেষণা।