ইউরোপীয় জীবনের অভিজ্ঞতা: বাংলাদেশী দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা।

ইউরোপে গত তিন মাসের বসবাসের অভিজ্ঞতা আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এখানে প্রতিদিনই অনেক নতুন জিনিস শিখছি এবং বেশ কিছু বিষয় আমাদের বাংলাদেশের সাথে তুলনা করে দেখার সুযোগ পেয়েছি। চেষ্টা করেছি সেই বিষয়গুলোই তুলে ধরার:

✍ খাবার দাবার:
ইউরোপে খাবারগুলো বেশ স্বাস্থ্যকর এবং বৈচিত্র্যময়। সবসময় সতেজ উপকরণ দিয়ে রান্না করা হয়, যা খেতে খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। বাংলাদেশে আমরা মশলাযুক্ত খাবার, ভাজাপোড়া এবং মিষ্টি খাবার বেশি পছন্দ করি। আমাদের দেশের খাবারগুলোর স্বাদও অনন্য, কিন্তু স্বাস্থ্যকর দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে থাকতে পারে।

✍ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা:
ইউরোপের রাস্তাঘাট, পার্ক এবং অন্যান্য জনসমাগমস্থল সবসময় পরিপাটি ও পরিষ্কার থাকে। প্রতিদিন পরিচ্ছন্ন কর্মীরা রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। বাংলাদেশে, বিশেষ করে শহর এলাকায়, পরিচ্ছন্নতার দিকে আমাদের আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা অনেক কষ্ট করে কাজ করেন, কিন্তু অধিক জনসংখ্যা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা সবসময় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারি না।

✍ শৃঙ্খলা এবং নিয়ম মেনে চলা:
ইউরোপে সবকিছু নিয়ম মেনে চলে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, সবকিছুই সময়মতো হয়। মানুষের মধ্যে এক ধরনের শৃঙ্খলা এবং পরায়ণতা দেখা যায়। বাংলাদেশে, যদিও আমরা অতিথিপরায়ণ এবং আন্তরিক, কিন্তু বেশিরভাগ সময় শৃঙ্খলার অভাব দেখা যায়। যানজট, সঠিক সময় মেনে কাজ না করা ইত্যাদি আমাদের দেশের একটি সাধারণ সমস্যা।

✍ পরিবেশ এবং জীবনযাত্রা:
ইউরোপের পরিবেশ সবসময় সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল। রাস্তাঘাটে গাছপালা, পার্ক, খেলার মাঠ ইত্যাদি সবকিছুই সুন্দর করে সাজানো থাকে। বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য, কিন্তু শহর এলাকায় এমন সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখা হয়তো যেকোনো মূল্যে অনেক কঠিন।

✍ মানুষের ভদ্রতা:
ইউরোপের মানুষজন বেশ ভদ্র এবং পরায়ণ। জনসমাগমস্থলে তারা অন্যদের প্রতি সম্মান দেখায় এবং নিয়ম মেনে চলে। বাংলাদেশে মানুষজনও আন্তরিক এবং অতিথিপরায়ণ, কিন্তু আমাদের সমাজে এখনও অনেক ক্ষেত্রে শিষ্টাচারের অভাব দেখা যায়।

This slideshow requires JavaScript.

✍ বাচ্চাদের স্কুল:
ইউরোপে বাচ্চাদের স্কুলের ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত এবং শিক্ষার মান খুবই উচ্চ। এখানে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস, যেমন খেলাধুলা, আর্ট, মিউজিক ইত্যাদি, শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য। এছাড়া, স্কুলের পরিবেশ খুবই পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ।

বাংলাদেশের স্কুলগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের স্কুলগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাব দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

✍ স্বাস্থ্যসেবা:
ইউরোপে স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত উন্নত এবং সহজলভ্য। প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে এবং চিকিৎসা পদ্ধতি অত্যন্ত আধুনিক। বাংলাদেশের  এখনও শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ কম।

✍ পরিবহন ব্যবস্থা:
ইউরোপের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা খুবই কার্যকরী এবং সময়নিষ্ঠ। ট্রেন, বাস, ট্রাম ইত্যাদি সবকিছুই নির্ধারিত সময়ে চলে এবং যাত্রীদের জন্য বেশ সুবিধাজনক। বাংলাদেশের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে, তবে যানজট এবং সময়নিষ্ঠতার অভাব এখনো সবচেয়ে বড় সমস্যা।

নিরাপত্তা:
ইউরোপে নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় এবং এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত তড়িৎ গতিতে নেয়া হয় এখানে লোকজনের সাথে কথা বলে আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি। শহরের রাস্তাঘাট, পাবলিক প্লেস, এবং পরিবহন ব্যবস্থায় সর্বদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবসময় সতর্ক অবস্থায় থাকে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা এবং অন্যান্য নজরদারির ব্যবস্থা থাকে, যা অপরাধের হার কমাতে সহায়ক। এখানকার চলাফেরায় দিন এবং রাতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, বিশেষ করে নিরাপত্তায়। আর আরেকটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি খেয়াল করেছি এখানে ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিরাপত্তার দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই বললেই চলে।

✍ বিশেষ অভিজ্ঞতা:
তবে একটি বিষয় আমার বেশ খারাপ লাগে, সেটা হলো ইউরোপের রাস্তাঘাটে অনেক সময় তাদের পালিত কুকুরের প্রস্রাবের গন্ধ। সকালে রৌদ্রে হাঁটতে বের হলে সেই গন্ধ নাকে আসে এবং এটা আমার জন্য খুবই অস্বস্তিকর। যদিও এখানকার পরিচ্ছন্ন কর্মীরা প্রতিদিন রাস্তাঘাট পরিষ্কার করে থাকেন, তবুও এই গন্ধটা রয়ে যায়।

✍  ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা:
আমার কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল এখানকার প্রকৃতির সৌন্দর্য, বৈচিত্র এবং চারপাশের পরিচ্ছন্নতা। পরিষ্কার বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া এবং সাজানো-গোছানো পরিবেশ সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এছাড়া, ইউরোপের সংস্কৃতি এবং মানুষের আন্তরিকতা ইতোমধ্যে আমার মন জয় করেছে। যেভাবে তারা নিয়ম মেনে চলে এবং অন্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তা সত্যিই অনুকরণীয়। আমি প্রতিদিন কিছু না কিছু তাদের সাথে যত মিশছি ততই শিখছি।

✍ দেশের প্রশংসা:
আমাদের দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, প্রকৃতির সান্নিধ্য, গ্রামীণ পরিবেশের প্রশান্তি, এবং মানুষের আন্তরিকতা আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে। গ্রামে থাকা সেই দিনগুলোর কথা যখন মনে পড়ে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে কাটানো সময়গুলো ছিল একদম নিখুঁত।

✍ পরিশেষে:
www.sumansaha.me-এ আরও ভ্রমণের গল্প এবং টিপসের জন্য আমার ব্লগটি দেখতে ভুলবেন না। দয়াকরে সব জায়গায় ভদ্রতা বজায় রাখুন আর প্লাস্টিক, পলিথিন ও অপচনশীল জিনিস এখানে সেখানে ফেলবেন না। প্রকৃতি পরিস্কার রাখার দায়িত্বও আপনার আমার সকলের। মনে রাখবেন ধনী-গরীব যেই হোক না কেন প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই সমান।

 

ইউরোপীয় জীবনের অভিজ্ঞতা: বাংলাদেশী দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা।

Write a comment....

Scroll to top
error: Content is protected !!